কখন সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না?

সাংবাদিকতা একটি সম্মানজনক পেশা, যার মূল লক্ষ্য সমাজের সেবা করা এবং জনগণকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সাংবাদিকতাকে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে ধরা হয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণের ফলে সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। এই নিবন্ধে সেই কারণগুলো বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।

সত্য ও নিরপেক্ষতার অভাব
সাংবাদিকতার মূলনীতি হলো সত্য উদ্ঘাটন ও জনগণকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা। যখন একজন সাংবাদিক রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক চাপের কারণে সত্যকে আড়াল করে বা তথ্য বিকৃত করে, তখন সাংবাদিকতা তার মূল চেতনা হারায়। সাংবাদিকের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে পাঠক বা দর্শকের আস্থা চলে যায়, ফলে এটি আর পেশা হিসেবে দাঁড়াতে পারে না।

নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের ঘাটতি
সাংবাদিকদের নৈতিকতা এবং পেশাদারিত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিগত লাভের জন্য যদি একজন সাংবাদিক মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেন বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারো ক্ষতি করেন, তাহলে এটি পেশা হিসেবে তার গুরুত্ব হারায়। নৈতিকতার অভাব সাংবাদিকতা পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং গণমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস কমিয়ে দেয়।

প্রোপাগান্ডার অংশগ্রহণ
কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা পেশা রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক স্বার্থের সাথে জড়িয়ে পড়ে, যা প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এর ফলে সংবাদমাধ্যমের মূল লক্ষ্য ভুলে গিয়ে, সাংবাদিকরা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রচারণায় লিপ্ত হন। এতে করে সমাজের প্রকৃত চিত্র জনসাধারণের কাছে পৌঁছায় না, বরং প্রভাবিত মতামত এবং তথ্য পরিবেশিত হয়। এ ধরনের প্রোপাগান্ডা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে ব্যর্থ করে তোলে।

তথ্যের সঠিক উৎস যাচাইয়ের অভাব
একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব হচ্ছে সঠিক তথ্য অনুসন্ধান করা এবং তথ্যের উৎস যাচাই করে তা প্রকাশ করা। কিন্তু যখন সাংবাদিকরা তাড়াহুড়ো করে বা দায়িত্বহীনভাবে যাচাইবিহীন তথ্য পরিবেশন করেন, তখন তা ভুল তথ্য বা গুজব ছড়ানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে পাঠক বা দর্শক বিভ্রান্ত হয় এবং সাংবাদিকতার উপর আস্থা হারায়।

বাণিজ্যিক চাপের প্রভাব
বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমগুলো কখনো কখনো বিজ্ঞাপন বা অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই প্রভাবের ফলে সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রকৃত সাংবাদিকতা ব্যাহত হয় এবং তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের স্বার্থ রক্ষা করার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। ফলে সাংবাদিকতার গুণগত মান কমে যায় এবং এটি আর পেশা হিসেবে গ্রহণযোগ্য থাকে না।

মুক্ত মত প্রকাশের বাধা
সাংবাদিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মুক্তভাবে মত প্রকাশ করা। কিন্তু যদি রাজনৈতিক বা সামাজিক চাপের কারণে সাংবাদিকরা নিজেদের মত প্রকাশ করতে না পারেন বা কোনো সংবাদের সত্য প্রকাশ করতে ভয় পান, তবে সেই সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে ব্যর্থ হয়ে যায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে সাংবাদিকতা তার প্রকৃত দায়িত্ব পালন করতে পারে না।

সাংবাদিকতা তখনই পেশা হিসেবে গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, যখন তা সত্য, নিরপেক্ষতা এবং নৈতিকতার পথ থেকে সরে যায়। একজন সাংবাদিকের প্রধান দায়িত্ব হলো সঠিক ও নির্ভুল তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং সমাজের সেবায় কাজ করা। নৈতিকতার অভাব, প্রোপাগান্ডায় যুক্ত হওয়া, বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সঠিক পেশাদারিত্ব বজায় রেখে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাই কেবল পেশা হিসেবে টিকে থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *