দাম্পত্য জীবনে আর্থিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও এক বা দুইজন সঙ্গী বেহিসাবি হয়ে উঠতে পারেন, যা ভবিষ্যতে সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা তৈরি করতে পারে। তবে অর্থের ব্যবস্থাপনা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও, তা সঠিকভাবে মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব। আপনার জীবনসঙ্গী বেহিসাবি হলে কী করবেন এবং কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন—এই প্রতিবেদনে তাই আলোচনা করা হবে।
১. বেহিসাবি জীবনসঙ্গী কীভাবে চিনবেন?
জীবনসঙ্গীকে বেহিসাবি হিসেবে চিহ্নিত করার আগে কয়েকটি লক্ষণ খেয়াল করতে পারেন:
বিনাকারণে অতিরিক্ত ব্যয়: সঙ্গী যদি সবসময় অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেন, নতুন নতুন জিনিস কেনায় আগ্রহী থাকেন এবং প্রয়োজনীয়তার বাইরে খরচ করেন, তা বেহিসাবি হওয়ার লক্ষণ হতে পারে।
বাজেট না মানা: সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট পরিকল্পনা থাকলেও, সঙ্গী যদি তা মানতে না পারেন এবং নিজের ইচ্ছামতো খরচ করতে থাকেন, তাহলে সেটি আর্থিক অব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়।
সঞ্চয়কে গুরুত্ব না দেওয়া: ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সঙ্গী যদি প্রতিবার সঞ্চয়ের ব্যাপারে অনীহা দেখান, তা হলে তার অর্থের প্রতি দায়িত্ববোধ কম থাকতে পারে।
ঋণের ফাঁদে পড়া: প্রায়ই ঋণ নেওয়া এবং তা সময়মতো পরিশোধ না করা বেহিসাবি হওয়ার একটি বড় লক্ষণ।
২. কেন জীবনসঙ্গী বেহিসাবি হতে পারেন?
কেউ বেহিসাবি হলে তার পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে। কিছু সাধারণ কারণ হতে পারে:
আর্থিক শিক্ষা বা সচেতনতার অভাব: অনেকে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ বা বাজেটের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। তারা মনে করেন, অর্থ শেষ হয়ে গেলে নতুনভাবে তা উপার্জন করা সহজ।
আবেগের বশে খরচ করা: অনেক সময় মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে খরচ করে ফেলেন। এটি মানসিক চাপ, হতাশা বা শখের কারণে হতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব: যদি জীবনসঙ্গী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা না করেন, তবে বর্তমান আর্থিক অবস্থাকে গুরুত্ব না দিয়ে খরচ করতে পারেন।
৩. কীভাবে সমস্যা মোকাবিলা করবেন?
আপনার সঙ্গী বেহিসাবি হলে, বিষয়টি কীভাবে মেটাবেন তা অনেকটাই নির্ভর করে আপনার এবং আপনার সঙ্গীর যোগাযোগের দক্ষতার উপর। কিছু পদক্ষেপ আপনাকে এই সমস্যার সমাধানে সহায়তা করতে পারে:
খোলামেলা কথা বলুন
সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হলো সঙ্গীর সাথে খোলামেলা আলোচনা করা। কোনো অভিযোগ না করে ধীরে ধীরে অর্থ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর চেষ্টা করুন। আপনি কেন অর্থ সঞ্চয় করতে চান বা কেন সঠিকভাবে বাজেট করা প্রয়োজন তা তাকে ব্যাখ্যা করুন। আলোচনা করার সময় ধৈর্যশীল থাকুন এবং মতপার্থক্য হলেও সেগুলো নিয়ে কাজ করুন।
যৌথভাবে বাজেট পরিকল্পনা তৈরি করুন
আপনার এবং আপনার সঙ্গী দুজনেরই আর্থিক পরিকল্পনা সম্পর্কে একমত হওয়া প্রয়োজন। একসাথে বসে পরিবারের আয়ের ভিত্তিতে একটি যৌথ বাজেট তৈরি করুন। সঙ্গীকে এ ব্যাপারে অংশীদারিত্বের অনুভূতি দিন যাতে তারা নিজেরা বুঝতে পারেন কীভাবে বাজেট তৈরি করলে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়।
ছোট লক্ষ্যে এগিয়ে যান
যদি আপনার সঙ্গী হঠাৎ সবকিছু বদলাতে না চান, তাহলে ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করে এগোন। উদাহরণস্বরূপ, মাসে কত টাকা সঞ্চয় করা সম্ভব বা অপ্রয়োজনীয় কোন খরচগুলো কমানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা করুন। ধীরে ধীরে তাকে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করুন।
সঞ্চয়ের মূল্য বোঝান
অনেক সময় মানুষ সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝেন না। সঙ্গীকে বোঝান সঞ্চয় আপনার ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা কীভাবে সঞ্চয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য কিছু বড় পরিকল্পনা করতে পারেন, তা নিয়ে আলোচনা করুন। যেমন—বাড়ি কেনা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা, বা অবসরকালীন জীবনের জন্য সঞ্চয় করা।
ক্রয় সীমা নির্ধারণ করুন
একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি টাকা ব্যয়ের আগে দুজনের মধ্যে আলোচনা করার নিয়ম চালু করুন। বড় কেনাকাটার আগে পরামর্শ করা হলে দুজনেই সচেতনভাবে অর্থ খরচ করতে পারবেন। এই পদ্ধতি উভয়ের মধ্যে দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে।
ঋণের ব্যবস্থাপনা করুন
যদি সঙ্গীর ওপর ঋণের বোঝা থাকে, তাহলে তা মিটিয়ে ফেলার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন। ঋণের উপর উচ্চ সুদের কারণে দাম্পত্য জীবনে চাপ তৈরি হতে পারে, তাই দ্রুত তা মেটানোর চেষ্টা করুন এবং সঙ্গীকে সেই পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত করুন।
৪. সমস্যা সমাধানে আরও কিছু কৌশল
আর্থিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বই বা কোর্স করা: অনেক সময় সঙ্গীকে আর্থিক ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বোঝাতে বই, ব্লগ, বা অনলাইন কোর্সগুলো উপকারী হতে পারে।
পরামর্শদাতা বা আর্থিক বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া: যদি সঙ্গীর বেহিসাবি আচরণ খুব জটিল মনে হয়, তাহলে পেশাদার কোনো আর্থিক পরামর্শদাতার সাহায্য নিতে পারেন। তারা আপনাদের সম্পর্কের মধ্যে আর্থিক সুশৃঙ্খলতা আনার জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন।
৫. সবশেষে—সম্পর্কের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিন
যদিও বেহিসাবি হওয়া সম্পর্কের জন্য একটি বড় সমস্যা হতে পারে, তবে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর্থিক সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে, খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে এবং ধৈর্যশীল আচরণের মাধ্যমে আপনি এবং আপনার সঙ্গী সমস্যার সমাধান করতে পারেন। মনে রাখবেন, সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং পারস্পরিক সম্মান। তাই আর্থিক সমস্যা থাকলেও সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে চলুন।
আপনার জীবনসঙ্গী যদি বেহিসাবি হন, তাহলে তা আপনার সংসারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে সঠিক আলোচনা, বাজেট পরিকল্পনা এবং আর্থিক সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। নিজেরা একসঙ্গে বসে আর্থিক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করুন এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি মজবুত পরিকল্পনা তৈরি করুন।